দাঁড়াও
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
বিষয়সংক্ষেপ
‘মানুষ’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে ‘মান’ ও ‘হুশ’ এর অর্থ। কিন্তু যত মানুষ আধুনিকতার শিখরে উত্তীর্ণ হয়েছে, ততই মানুষ হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী ও ক্ষমতালোভী। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘দাঁড়াও’ কবিতাটির মধ্যে মানুষের মানবিকতার অবক্ষয়ের দিকটিকে তুলে ধরেছেন। মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ ইত্যাদি যেগুলি মানুষের সদগুণ বলে বিবেচিত, সেইসমস্ত গুণসম্পন্ন মানুষকে তিনি অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সমস্ত মানুষের কথা কবি সর্বদা মনে করেন এবং যেভাবেই হোক, প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের পাশে এসে যেন দাঁড়ায় এটাই কবির একমাত্র প্রার্থনীয় বিষয়।
আসলে কবি বিশ্বাস করেছেন, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে হোক কিংবা নিঃসঙ্গতা, অসহায়তায় মানুষ যেন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হয়, ব্যথিত মানুষের সমব্যথী হয়ে ওঠে।
হাতেকলমে
১.১ শক্তি চট্টোপাধ্যায় কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ?
উঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বহড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১.২ তাঁর লেখা একটি উপন্যাসের নাম লেখো। ।
উঃ তাঁর লেখা একটি উপন্যাসের নাম হল- ‘অবনী বাড়ি আছো?”
২ নীচের প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :
২.১‘মতো’ শব্দ ব্যবহার করা হয় কখন ? তোমার যুক্তির পক্ষে দুটি উদাহরণ দাও।
উঃ দুটি বিষম বস্তুর সঙ্গে তুলনা বোঝাতে বা সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্য কল্পনা করতে ‘মতো’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন – তার গাঁয়ের রঙ্গ দুধের মতো সাদা অর্থাৎ তার অঙ্গের রঙ্গ ও দুধের রঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
আমাদের পাঠ্য কবি জীবনানন্দ দাশের ‘পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি’ কবিতা থেকে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়—“নকশাপেড়ে শাড়িখানা মেয়েটির রৌদ্রের ভিতর/হলুদ পাতার মত সরে যায়” কবি এখানে রৌদ্রের ভিতর মেয়েটির শাড়ির সঙ্গে জীর্ণ, হলুদ পাতার তুলনা করে ‘মতো’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
২.২ কবি পাখির মতো পাশে দাঁড়াতে বলছেন কেন ?
উঃ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবনকে কঠিন বাস্তবের মাটি থেকে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ আসলে অসহায় ও বড়ো একা। ফলে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাকে পরিত্যাগ করে মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে পাখির আছে স্বাধীনতা, গতিবেগ ও চঞ্চলতা। পাখিদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব নেই। নেই সামাজিক জটিলতার স্পর্শ। তাই কবি পাখির মতো মানুষকে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে বলেছেন।
২.৩ ‘মানুষই ফাঁদ পাতছে‘—কবি এ কথা কেন বলেছেন ? ‘মানুষ’ শব্দের সঙ্গে ‘ই’ ধ্বনি যোগ করেছেন কেন তোমার কী মনে হয় ?
উঃ সমাজসচেতন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সমাজের বিকৃতি ও ব্যভিচার দেখে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। এই সমাজের জটিল আবর্তে পড়ে মানুষের মধ্যে থেকে মনুষ্যত্ববোধ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। একে অপরকে আক্রমণ করার জন্য, ঠকাবার জন্য মানুষ যেন জাল পেতে আছে। তাই কবি এখানে বলেছেন—“মানুষই ফাঁদ পাতছে”।
‘মানুষ’ শব্দের সঙ্গে ‘ই’ ধ্বনি যোগ করে মানুষকেই দায়ী করতে চেয়েছেন কবি। এই পৃথিবীতে মানুষ হল শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের মধ্যে দয়া-মায়া, ভদ্রতানম্রতা, পারস্পরিক সাহায্য-সহানুভূতি ইত্যাদির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। আবার এই মানুষই মানুষকে ঠকায়, শোষণ করে, খুন করে। মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরতার কথা জোর দিয়ে বোঝাতেই কবি ‘ই’ ধ্বনিটি যোগ করেছেন।
২.৪ তোমার মতো মনে পড়ছে’ –এই পঙক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ কী ?
উঃ আলোচ্য পঙক্তিটির মাধ্যমে কবি মানুষের অসহায়তার কথাটিকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। অবক্ষয়ী সমাজে মানুষ বড় একলা হয়ে পড়েছে। মানুষের ওপর শোষণ-পীড়ন চালাচ্ছে আরেক দল মানুষ। সামাজিক বিকৃতি ও ব্যভিচার যেন মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছে। মানুষ ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। অথচ, এই মানুষেরই মধ্যেই আছে বহু সদগুণের সমাবেশ। মানুষের মধ্যে যে-সমস্ত সদগুণগুলি আছে—সেই গুণগুলিরই বহিঃপ্রকাশ কামনা করছেন কবি, সেই মানবিক মানুষের কথাই কবির মনে পড়ছে।
২.৫ “এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও”– এই পঙক্তিটির বিশেষত্ব কোথায় ? এই ধরনের দুটি বাক্য তুমি তৈরি কর।
উঃ আলোচ্য পৃঙক্তিটির বিশেষত্ব নানাভাবে লক্ষণীয়।প্রথমত, ‘এসে,ভেসে’, ‘বেসে’—তিনটিই অসমাপিকা ক্রিয়াপদ সম্পূর্ণ বাক্যটি তিনটি অসমাপিকা ক্রিয়াপদ দ্বারা গঠিত। দ্বিতীয়ত, শব্দগুলির মধ্যে একটি ছন্দগত মিল লক্ষ করা যায়।
এমন ধরনের দুটি বাক্য হল— (ক) দিয়ে থুয়ে তুমি খেয়ে নাও।(খ) হেঁটে যাও ছুটে যাও তারপর জু যাও।
৩ “মানুষ বড়ো কাঁদছে”—কী কারণে কবি এই কথা বলেছেন?
উঃ সমগ্র পৃথিবী জুড়েই চলছে বিশ্বযুদ্ধ, ঠান্ডা লড়াই, বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রপন্থী মানসিকতা ও ধর্মের লড়াই। সমাজমনস্ক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবনকে দেখেছেন কঠিন বাস্তবের মাটি থেকে। সেহেতু সমাজের বিকৃতি ও ব্যভিচার দেখে কবি মর্মাহত। সমাজের জটিল আবর্তে পড়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে স্বার্থান্বেষী মানুষরা মেতে উঠেছে অত্যাচার ও উৎপীড়নের খেলায় । তারা বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে জীবন যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছে। এই সমস্ত মানুষদের জন্য কবি খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন সমগ্র মানবজাতি অসহায়ের মতো কাঁদছে।
৪“মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও”। এই পঙক্তিটিকে তিনবার ব্যবহার করার কারণ কী হতে পারে বলে তোমার মনে হয় ?
উঃ আলোচ্য পঙক্তিটিকে সমগ্র কবিতায় তিনবার ব্যবহার করে কবি দুটি বিষয়কে তীব্রতর করে তোলার চেষ্টা করেছেন। একটি হল ‘মানুষ বড়ো একলা অর্থাৎ মানুষের অসহায়তা, একাকিত্ব বার বার ফুটিয়ে তোলার জন্য এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে।দ্বিতীয়টি হল ‘তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও অর্থাৎ, মানুষের দ্বারাই তার এই অসহায় অবস্থা নিরাময় করার প্রচেষ্টা করা উচিত। তাই আলোচ্য বাক্যটিকে তিনটি অনুচ্ছেদে তিনবার ব্যবহার করে কবি তাঁর বক্তব্যকে খুব জোরালো, স্পষ্টতর ও প্রবলতর করার চেষ্টা করেছেন।
৫ কবিতাটির নাম ‘দাঁড়াও‘ কতটা সার্থক ? কবিতাটির নাম ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ হতে পারে কি তোমার উত্তরের ক্ষেত্রে যুক্তি দাও।
উঃ নামকরণ যখন বিষয়কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, তখন সাহিত্যের নামকরণ-এর মধ্য দিয়ে বিষয়বস্তুর গভীরে সরাসরি প্রবেশ করা সম্ভব হয়। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আলোচ্য কবিতাটির নাম রেখেছেন ‘দাঁড়াও। নামকরণ করার ক্ষেত্রে যে-বিষয়গুলি বিবেচ্য, কাহিনির ব্যঞ্জনাধর্মিতা তাদের মধ্যে একটি, যেটি প্রদত্ত কবিতার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে। কবিতাটির কাহিনির দিকে নজর দিলে দেখা যায়, অবক্ষয়ী সমাজে জীবন-যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। সুতরাং, মানুষ হয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন না-চালিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে কবির ধারণা কবিতাটির মূল বিষয় হল—মানুষ অসহায় হয়ে কাঁদছে। ফলে মনুষ্যত্ব ও বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ সেই অসহায় ক্রন্দনরত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াক। সমগ্র কবিতাটির বক্তব্য-বিষয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টিতে কবি বেশি জোর দিয়েছেন। কারণ, যেভাবেই হোক এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও”—মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এটি একটি আকুল আবেদন। তাই কবিতাটির নামকরণ ‘দাঁড়াও’ অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত ও সার্থক হয়েছে।
৬ কবি কাকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করছেন বলে তোমার মনে হয় ?
উঃ প্রদত্ত কবিতাটিতে কবি মানুষকেই মনুষ্যত্ববোধ, শুভ চেতনা ইত্যাদি সদগুণগুলির জাগরণের মধ্য দিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে অনুরোধ করেছেন। এই বোধই পারে মানুষকে অমানুষিক তথা বর্বর আচরণ থেকে মুক্ত করতে। বর্তমান সময়ে কিছু মানুষ হিংসায় মত্ত হয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার করতে কুণ্ঠিত হয় না। তাই কবি বিবেকবান মানুষকে সেই সমস্ত উৎপীড়িত অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
৭ কবিতাটি চলিত বাংলায় লেখা, শুধু একটা শব্দ সাধু ভাষার। শব্দটি খুঁজে বার করো এবং শব্দটিকে এভাবে ব্যবহার করেছেন কেন কবি ?
উঃ আলোচ্য কবিতাটি চলিত ভাষায় লেখা। শুধু একটিমাত্র শব্দ সাধুভাষায় লেখা, সেটি হল ‘তাহার।
শব্দটিকে এভাবে ব্যবহার করে কবি সম্ভবত অসহায় মানুষদের বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। নিত্য ব্যবহার্য শব্দের বদলে বা তার পাশাপাশি সাধু শব্দ ‘তাহার’ ব্যবহার করে বক্তব্যকে আরও গভীর করে তুলতে চেয়েছেন কবি। সম্ভবত, এ কারণেই তিনি কবিতার মধ্যে ওই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন। আসলে ‘তার’ শব্দের পরিবর্তে ‘তাহার’ শব্দের বিস্তৃতি অনেক বেশি। তাই, চলিত ভাষার মধ্যে সাধু শব্দের ব্যবহার সেই ব্যপ্তিকেই ব্যঞ্জিত করে তোলে।
৮ প্রথম স্তবকের তিনটি পঙক্তির প্রত্যেকটির দলসংখ্যা কত ? প্রতিটি পঙক্তি ক–টি রুদ্ধদল ও মুকদল নিয়ে তৈরি ?
প্রথম চরণ = মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও-মানুষ (মানুষ), বড়ো (বডো), কাঁদছে (কাঁদ-ছে), তুমি (তুমি), মানুষ (মানুষ), হয়ে (হ-য়ে), পাশে (পা-শে), দাঁড়াও (দাঁড়াও), দলসংখ্যা—১৬টি।
দ্বিতীয় চরণ = মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও—মানুষই (মা-নুষ-ই), ফাঁদ (ফাঁদ), পাতছে (পাত-ছে), তুমি (তুমি), পাখির (পাখির), মতো (ম-তো), পাশে (পা-শে), দাঁড়াও (দা-ড়াও), = দলসংখ্যা ১৬টি। )
তৃতীয় চরণ = মানুষ বড়ো একলা তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও—মানুষ (মা – নুষ), বড়ো (ব – ড়ো), একলা (এক – লা), তুমি (তু – মি), তাহার (তা – হার), পাশে (পা – শে), এসে (এ – সে), দাঁড়াও (দাঁ – ডাও), = দলসংখ্যা—১৬টি।
প্রথম স্তবকের তিনটি পঙক্তির প্রত্যেকটির দল সংখ্যা ১৬ (যোলো)। প্রথম পঙক্তি—১২ টি মুক্তদল এবং ৪টি রুদ্ধদল নিয়ে গঠিত।
দ্বিতীয় পঙক্তি—১১টি মুক্তদল এবং ৫টি রুদ্ধদল নিয়ে গঠিত।
তৃতীয় পঙক্তি—১২ টি মুক্তদল এবং ৪টি রুদ্ধদল নিয়ে গঠিত।
৯ কী ঘটেছে লেখো : সন্ধ্যা < সন্ধে। ফাদ < ফাঁদ।
সন্ধ্যা < সন্ধে (স্বরসংগতি)।
ফাদ > ফাঁদ (নাসিক্যীভবন)।
Click Here To Download The PDF